গল্প- বদ অভ্যাস

।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।

 

বদ অভ্যাস
-সুমিতা পয়ড়্যা

 

 

টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা হয়ে এলো যেন! বাড়ির সামনে দিয়ে লম্বা রাস্তা চলে গেছে চৌরাস্তার মোড় পর্যন্ত। সেই রাস্তার আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। দু-একটা ঝাঁপ ফেলা দোকান খোলা। রাস্তাতে লোকজন নেই, একেবারে শুনশান।
দূরে কোথাও মেঘমল্লার রাগের সুর ভেসে আসছে। বাতাসে ঝোড়ো হওয়া। স্যাঁতসেতে বাতাসে গরম গরম আর চা খেতে ইচ্ছে হলো অক্ষয়বাবুর।
বয়সটা প্রায় ষাট ছুঁই ছুঁই করছে। কদিন পরেই চাকরি জীবনের অবসর নেবেন। ছেলেমেয়েরা সব বাইরে চাকরির সূত্রে। বাড়িতে এখন লাবু আর তিনি।
লাবু হলো গিয়ে অক্ষয়বাবুর একমাত্র সঙ্গী লাবণ্যময় দেবী। যেমন তার প্রভা তেমন তার গুণ। একাই এই বয়সেও সংসারটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছেন। অক্ষয়বাবু মুখে কিছু না বললেও ভিতরে ভিতরে স্ত্রীকে নিয়ে একটা আলাদা গর্ববোধ করেন। উপরে সবসময় খুনসুটি। এতে লাবুর মেজাজ থাকে সপ্তমে চড়ে। আর অক্ষয়বাবু এটাই উপভোগ করেন খুব বেশি করে। নুন ছাড়া রান্নার স্বাদ কেমন বিষাদ হয় তেমনি লাবণ্যময়ী দেবীর চিৎকার বকবক ছাড়া সংসারটাও কেমন যেন বিস্বাদ লাগে অক্ষয়বাবুর।
সাহসে ভর করে অক্ষয়বাবু বলেই ফেললেন, লাবু ভিশন চা আর পকোড়া খেতে ইচ্ছে করছে; খাওয়াবে গো!
লাবণ্যময়ী দেবী বলে উঠেন, এত খাই খাই করো না তো! শরীরটা ঠিক রাখতে হবে, বয়স হয়েছে এটা জানো তো!
বলে নিয়ে আবারও বললেন—-ঠিক আছে, আজ দিচ্ছি। ঘনঘন বলবে না কিন্তু!
অক্ষয়বাবু হেসে উঠলেন, বললেন–না না আজই প্রথম, আজই শেষ। আমি জানতাম তুমি আমাকে না বলতে পারবে না। তাইতো তোমাকে এত ভালোবাসি।

লাবণ্য দেবী হাসতে হাসতে বললেন, খুব হয়েছে! বলেই রান্না ঘরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই চা আর পকোড়া এসে হাজির।
দুজনে মুখোমুখি বসলেন ব্যালকনিতে। খাওয়া শুরু করলেন গল্প করতে করতে।

কিন্তু যেটা হবার সেটা তো হবেই। যা ঘটবার তা তো ঘটবেই। সেখানে কারুর কিছু করার থাকে না।

হঠাৎ অক্ষয়বাবুর হাতটা কেঁপে ওঠে আর চায়ের কাপটা থেকে ছলকে খানিকটা গরম চা পড়ে যায়। পড়বি তো পড় একেবারে লাবণ্যময়ী দেবীর পায়েই পড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে লাবু দেবী হাঁ হাঁ করে উঠলেন—-কি যে করো বুঝি না বাপু! সবকিছু তোমারই কি হতে হয়? অসহ্য! যত্তসব বদ অভ্যাসের রাজা। গরম চা টা ফেললো ফেললো আমার পায়েই ফেললে। মেঝেতেও তো পড়তে পারতো! তানা সেই আমার কপালে। উফফ! কি যন্ত্রনা মাগো। এদের হাত থেকে আমার নিস্তার নেই।

অক্ষয় বাবু বললেন, আরে ইচ্ছে করে করেছি নাকি! হঠাৎ হাতটা কেটে গেল। তা আমি কি করবো বলো! শান্ত হও লাবু। সরি লাবু। দেখি কোথায় লাগলো! গরম চা টা পড়েছে। পুড়ে গেল কিনা দেখি। দাও পাটা। একটু বার্নল লাগিয়ে দিই। দেখাও পা টা। আর কখনো হবে না।
সরি- সরি- সরি।

লাবণ্যময়ী দেবী বকবক শুরু হয়েছে। থামানোটা অত সহজ নয়। তবু বলে গেল এক নিঃশ্বাসে—–

আমার তো সকাল-সন্ধ্যা বলে কিছু নেই; শখ- আহ্লাদ বলে কিছু নেই।
তার ওপর যত বদঅভ্যাসগুলো সব সহ্য করতে হবে। খালি কাজ বাড়াও। কোন কাজই তো কোন সাহায্য নেই, শুধু অকাজ। দুমিনিট শান্তিতে বসব তারও উপায় নেই। তুমি কেমন মানুষ কে জানে? ভগবান কি দিয়ে তৈরি করেছেন তোমাকে?

অক্ষয়বাবুও কম যান না। বলে ফেললেন—‘যত দোষ নন্দ ঘোষ।’
ব্যাস আর যান কোথায়?

লাবণ্যময়ী দেবী বলে ওঠেন: না মশাই! কেউ এমনি এমনি বলে না। একটাও যদি ভাল অভ্যাস দেখতাম তাহলে আর বলার জায়গায় থাকত না। সব বাজে অভ্যাস— যাকে বলে বদ অভ্যাস।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেশের মধ্যে নাক ঝাড়া —কোথায় গিয়ে কি পড়ল তা কে দেখে শুনি! সেই তো আমি। কোনদিন বেসিনটা পরিষ্কার করেছ?না তো!
কোনদিন দেখলাম না পাপোশ গুলো সুন্দর করে ঠিক জায়গায় রয়েছে। দোমড়ানো মোচড়ানো—-
পাপোশ দিয়ে কেউ পায়ের ওপরের জল গুলো মুছে জানা ছিল না। তোমার সঙ্গে বিয়ে না হলে জানতেই পারতাম না।
যেখানে বই পড়ছে সেখানে বই খুলে রেখে চলে গেলে। কে গোছায় শুনি! ছোটবেলায় শুনেছিলাম বই খুলে রাখলে ভুতে পড়ে নেয়। তুমি নিজেই একটা ভূত তাই তোমার কাছে কোন ভূতেরাও আসবেনা। ওরাও জানে তোমার ছিরিগুলো! কি সুন্দর সুন্দর সব অভ্যাস! এক্কেবারে যা তা।

এইতো সেদিন চোখের চশমাটা পড়ার সময় নিয়ে পড়বে তারপর তাকে খুঁজতে গিয়ে ঘরবাড়ি সব লন্ডভন্ড করবে। করেছিলে কিনা বল! তোমার সঙ্গে কোন মানুষ থাকবে? কেউ থাকবে না। আমি বলে বর্তে গেলে এ যাত্রায়।
তুমি যে কি পারো আর কি পারো না, তা একমাত্র আমি আর ওই ওপর ওয়ালায় জানেন।
বাথরুমে যাবে জল দেবে না। জলের নাকি ঘাটতি চলছে! পরবর্তী প্রজন্ম খেতেই পাবেনা। তাই বাথরুমে জল না দিয়ে জল জমাচ্ছেন। তোমাকে পৃথিবীর সব জল ধরে রাখার দায়িত্ব দিয়েছেন ভগবান।
আর এদিকে ফ্ল্যাট বাড়িতে যে গন্ধে গন্ধে বাস করাটা কি দুর্বিষহ তা কে ভোগ করে শুনি! খুব যে বড় বড় কথা বলছে!

জায়গার জিনিস জায়গায় থাকলে অন্ধ মানুষও খুঁজে পায়। সেই কোন ছোটবেলায় বাবার কাছে শুনেছিলাম। আজো তা পালন করে চলেছি। আর তুমি তো চোখ থাকতেও অন্ধ। কিছুই খুঁজে পাওনা। এক জায়গার জিনিস কোথায় গিয়ে বাস করছে তা এই আমি ছাড়া কেউ জানে না।

অক্ষয়বাবু আবার বলে উঠলেন—–তোমার কি কোন বদ অভ্যাস নেই। যদি তোমারটা বলি!
লাবণ্য দেবী আবার বলে উঠলেন—-হ্যাঁ! হ্যাঁ! বল! বলো না! থামলে কেন! দেখি কি দোষ দেখতে পাচ্ছ!
বছরে কটা ছাতা হারাও খেয়াল আছে? ভোটের ডিউটি সারতে গিয়ে প্রতি ভোটে লুঙ্গি- গামছা- মশারি আমি ফেলে আসি, আমি! তাই না! নতুন জিনিস গুলো পাল্টে পুরনো নিয়ে আসি আমি।
আর কত বলব! বলতে গেলে মহাভারতও মুখ লুকাবে। বদ অভ্যাসের রাজা তুমি। বুঝেছ!
মানুষ চেষ্টা করে নিজেকে পাল্টাতে। ভালো হতে। ভালো ভালো অভ্যাস গড়ে তুলতে। সেটা তোমার দ্বারা হবে না তা আমি অনেক আগেই বুঝেছি। আর যার নয়ে হয় না তার নব্বই এ হবে! কক্ষনো না। কোনদিনও না।

দেখছো,এই পকোড়াগুলো খেয়ে তেলটা কেমন গেঞ্জিতে মুঝে নিলে! দেখেছো তোমার কি অবস্থা! দিনে দিনে কি যে হবে কে জানে! আমাকে আরো কতই না সহ্য করতে হবে!

লাবু অশান্তি করো না। চুপ করো প্লিজ। এত মাথা গরম করতে নেই।
দেখো তোমারও অনেক বদ অভ্যাস আছে। আমি কিছু বলি না তাই।

মানুষ মাত্রেই ভালো মন্দ অভ্যাস থাকে। কারো বেশি তো কারুর কম এই যা। কিন্তু থাকে তো। সে গুলোকে এভাবে বলার কি আছে? ভালো লাগবে না সেদিকে দেখবে না। আমিও দেখি না। তাই কখনো তোমাকে কিছু বলিও না।

লাবণ্য দেবী বললেন: থামলে কেন? বল বল, বাকি রাখছো কেন? এইটা বাকি আছে বলে ফেলো!
অক্ষয় বাবু বললেন: আজ্ঞে না, তোমার মত এত বকবক বা ঝগড়া করার অভ্যাস আমার নেই, অপ্রয়োজনীয় কথা নাই বা বললাম।
লাবণ্য দেবী আবার বলে উঠেন: ও আমি ঝগড়া করি, বকবক করি—তাই না! ঠিক আছে মনে থাকে যেন! এই আমি মুখ বন্ধ করলাম। আর কোন কথাই বলবো না। দেখি তুমি কি করে থাকো?

অক্ষয় বাবু বললেন, আরে, মহা মুশকিল! আমি কি তাই বললাম! ওটা তো কথা প্রসঙ্গে কথা বলা। লাবু তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি। রাগ করো না প্লিজ। লাবু শুনছো!

এই লাবু ডাকে একটা মাদকতা আছে। এটা লাবণ্যময়ী দেবী ভিতরে ভিতরে বারংবার উপলব্ধি করেছেন। তখন যেন সব রাগ, সব ক্ষোভ এক নিমেষে কোথাও উধাও হয়ে যায়। প্রেমের জোয়ার এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় দূরে- দুরান্তে কোন এক অজানা দেশে। আসলে অক্ষয়বাবু মানুষটা তো খুব ভালো মানুষ।
সামান্য কারণে একটু বেশি বেশিই করে ফেলেন লাবণ্যময়ী দেবী। নিজের ভুলটা বুঝতে দেরি হয় না তার।
সমস্ত রাগ উধাও করে লাবণ্যময়ী দেবী বলে বসলেন, আর এক কাপ চা দেবো নাকি?
অক্ষয় বাবু বললেন, দেবে বলছো! দাও তাহলে!

দুজনে দুজনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। যেন সেই অবশ হওয়া চাহনি—যাকে বলে শুভদৃষ্টি! দুজনেই যেন এক আত্মার আত্মীয় হয়ে ওঠেন এক পূর্ণতায়। এ যেন সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠে বিশ্বাস আর ভরসায়। রাতের আকাশের চাঁদটাও ফেল ফেল দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে অবাক বিস্ময়ে।
দুজনেই একসঙ্গে বলে ওঠেন: দেখো, চাঁদটা কেমন দেখছে আমাদেরকে! বলেই দুজনে হা হা হা হা করে হাসিতে পুরনো হয়ে ওঠেন।
আর দুজনেই একসঙ্গে গেয়ে ওঠেন—-
“এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়
একি! বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু…………………।”

Loading

Leave A Comment